ত্রিপুরাইনফো-র মেগাকুইজ: ২০ বছরের জ্ঞানের যাত্রা এখন জাতীয় স্তরে ছড়িয়ে পড়ুক

অশেষ সেনগুপ্ত

November 10, 2025

জ্ঞান শুধু মাথায় জমে থাকা কিছু তথ্য নয়। জ্ঞান মানুষের চিন্তা, সমাজবোধ ও মানবিকতার ভিত্তি। আর সেই জ্ঞানকে আনন্দের সঙ্গে, প্রতিযোগিতার উত্তাপে এবং সৃজনশীলতার আলোয় রাঙিয়ে তুললে যা হয়, তারই নাম কুইজ। বহু প্রশ্ন, অসংখ্য কৌতূহল আর উজ্জ্বল তরুণ মন, এই তিনের মিলিত মঞ্চে ৯ নভেম্বর ২০২৫, রবিবার রাজধানী জেগে উঠেছিল বার্ষিক এক জ্ঞানোৎসবে। ত্রিপুরা ইনফো ডট কম আয়োজিত অল ত্রিপুরা মেগা কুইজ ছিল তার প্রমাণ। প্রশ্ন, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ আর বুদ্ধির লড়াইয়ে দিনটিকে ঘিরে ছিল গভীর উৎসাহ।

এই বছর প্রতিযোগিতা দুই গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে বিভক্ত ছিল। একটি বিদ্যালয় ভিত্তিক এবং অন্যটি সাধারণের জন্য উন্মুক্ত। কেবল সাধারণ তথ্য নয়; বিজ্ঞান, সমাজ, শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত ও ভ্রমণের মতো নানা দিকের প্রশ্নও কুইজের অংশ হয়েছে, ফলে মঞ্চটি হয়ে উঠল জ্ঞানানুসন্ধানের বহুমাত্রিক মঞ্চ।

সকাল ১০:৩০ মিনিটে নির্দিষ্ট সময়ে এক নম্বর প্রেক্ষাগৃহে শুরু হয় লিখিত স্ক্রিনিং টেস্ট। অভিজ্ঞ পরীক্ষকরা সেই লিখিত পর্ব থেকেই বেছে নেন—বিদ্যালয় বিভাগে সেরা আট জুটি ও উন্মুক্ত বিভাগে সেরা ১৬টি জুটি; এরপর শুরু হয় জীবন্ত প্রতিযোগিতা। পুরো প্রক্রিয়াটিই ছিল সুসংগঠিত, অনিবাৰ্য উত্তেজনায় পূর্ণ।

আয়োজকদের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধা জানানো হয় ত্রিপুরা ইনফো-র প্রয়াত শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি। কর্ণধার জয়ন্ত দেবনাথের জননী স্বর্গীয়া জোৎস্না রাণী দেবনাথ, দৈনিক সংবাদ-এর প্রয়াত সম্পাদক প্রদীপ দত্ত ভৌমিক, তপেশ দেবনাথ, মৃন্ময় চৌধুরী এবং লেখক রামকৃষ্ণ দাস ওরফে কর্মা জ্ঞান বজ্র রেপা। তাঁদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করে পরিবারকে শ্রদ্ধাস্মারক তুলে দেন আয়োজকরা। সেই মুহূর্তটিতে পুরো দিনের একটি নীরবতাময় শ্রদ্ধার স্পর্শ রেখে যায়। প্রতিবারের মতো এবছরও দর্শকদের অংশগ্রহণের জন্য ছিল আকর্ষনীয় সুযোগ, আট থেকে আশি সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল এই মেগা কুইজ। দেশের সেরা সর্বাধিক তিনজন শিক্ষিত মুখ্যমন্ত্রী হলেন যথাক্রমে মধ্য প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মোহন সিং, আসামের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা, ও ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ডা মানিক সাহা।

ত্রিপুরাইনফো-র সম্পাদক জয়ন্ত দেবনাথ এর নগদ দুই হাজার টাকার এই প্রশ্নের মাধ্যমে কুইজের শুভ সূচনা ঘটে। তার পর মূল পর্বে কুইজ মাস্টার অভিজিৎ ভট্টাচার্যের প্রশ্নে শুরুতেই ছিল একটি বাইসাইকেল পুরস্কার; তার পরেই প্রশ্নের ধারা চলতে থাকে, উত্তর খুঁজে ছুটে চলা প্রতিযোগীদের উৎসাহ বাড়িয়ে তোলে। কেবল সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন নয়, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সচেতনতা জাগানোর লক্ষ্যে চমৎকার কিছু প্রশ্ন রাখা হয়েছিল। প্রসাদ স্কিমে তৈরি নবনির্মিত ত্রিপুরাসুন্দরী পীঠস্থান থেকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, ঘনীভবন, মাইটোকন্ড্রিয়া, প্রজাপতি থেকে গ্রীন ইম্পেরিয়াল পিজিয়ন, বিষয়বৈচিত্র্য ছিল চোখে পড়ার মতন। প্রতিটি সঠিক উত্তরে বিজয়ী পেয়েছেন আকর্ষণীয় পুরস্কার যেমন স্মার্টফোন, স্মার্ট টিভি, কলকাতায় বিমানের টিকিট, বাইসাইকেল এবং রাজ্যের পাঁচতারা হোটেলে রাত্রিযাপন ইত্যাদিতে আয়োজকদের উদারতা ছিল স্পষ্ট।

মূল স্ক্রিনিং চলাকালে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার। তাঁর বক্তব্য ছিল জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণের অনুরাগমাখা বার্তা। দুই দশকের এই ধারাবাহিক আয়োজনের প্রশংসা করে তিনি বলেন — তথ্যভান্ডার সমৃদ্ধ হওয়া, বৈশ্বিক ও সামাজিক চেতনা বিকাশ, এবং প্রতিকূলতার মধ্যেও জ্ঞানচর্চা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, এই অনুষ্ঠান ত্রিপুরার বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল অধ্যায়। বিশ্ব অর্থনীতির উত্তাপে পড়ে থাকা উন্নয়নশীল সমাজের জন্য বিকল্প ভাবনার প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেন তিনি।

বিদ্যালয় বিভাগের ফাইনালে মঞ্চে উঠে আসে সেরা আট জুটি। প্রথম পর্ব পরিচালনা করেন রাজ্যের পরিকল্পনা দপ্তরের কর্মকর্তা নন্দু কুমার পানিক্কর; তাঁর দেওয়া প্রশ্ন ছিল সংবিধানের প্রস্তাবনা সংক্রান্ত। দ্বিতীয় পর্বে মাইক্রোফোন ধরেন তরুণ কুইজ মাস্টার মধুজা দেবনাথ (মাহি), যাঁর প্রশ্নগুলো 'কনস্টান্টিনোপল' থেকে শুরু করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মধুজার প্রশ্ন ও উপস্থাপনার গভীরতা দর্শকদের মুগ্ধ করে। চূড়ান্ত রাউন্ড পরিচালনা করেন স্কুল অফ সায়েন্সের অধ্যক্ষ অভিজিৎ ভট্টাচার্য; এক মিনিটের র‍্যাপিড ফায়ারে সুর চড়িয়ে ওঠে উত্তেজনা, দর্শকও নিরবভাবে প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করে।

উন্মুক্ত বিভাগে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিল ছাত্রদের পাশাপাশি অধ্যাপক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সিভিল সার্ভেন্ট এবং এমনকি পিতা-পুত্রের জুটি। প্রথম ধাপ থেকে দ্বিতীয় ধাপে বাছাই করে বেছে নেওয়া হয় সেরা আট জুটি। এবং চূড়ান্ত রাউন্ডে র‍্যাপিড-ফায়ার রাউন্ডের মধ্যে দিয়ে ঘোষণা করা হয় সেরার সেরা জুটিদের। খুদে প্রতিযোগীদের আত্মবিশ্বাস ও মেধার প্রদর্শনে সবাই অভিভূত হয়।

অনুষ্ঠানের মূলপর্বের উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রফেসর (ডা.) মানিক সাহা। তিনি স্বামী বিবেকানন্দের উদ্ধৃতি স্মরণ করে বলেন, মানুষের মস্তিষ্কের গ্রন্থাগার সমৃদ্ধ করার জন্য এ ধরনের আয়োজন অপরিহার্য। তিনি বাস্তবিকভাবে আশাবাদী যে ত্রিপুরা ইনফোর উদ্যোগ উত্তর-পূর্বের সীমা পেরিয়ে জাতীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে যাবে এবং ত্রিপুরার এই উদ্যোগটি রাজ্যের পরিচিতি বাড়াতে সহায়ক হবে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সমাজকল্যাণ ও সমাজ শিক্ষা, যুব ও ক্রীড়া এবং শ্রম দপ্তরের মন্ত্রী টিংকু রায় এবং রাজ্যসভা সাংসদ রাজীব ভট্টাচার্য; তাঁরা সরকার ও সংস্থার যৌথ প্রয়াসে মেগা কুইজকে আরও প্রসারিত করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন এবং ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ উচ্চশিক্ষার জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরী করবে বলে আশা ব্যক্ত করেন।

দিনজুড়ে ছিল বিনোদন ও তথ্যবহুল নানা অনুষ্ঠান। যেমন- অডিও-ভিজ্যুয়াল সেগমেন্ট, সৃজনশীল প্রশ্নাবলী, প্রয়াত গায়ক জুবিন গর্গকে স্মরণ করে তাঁর সংগীতভিত্তিক প্রশ্ন এবং 'অপারেশন সিন্দুর' ও ভারতীয় মহিলা দলের বিশ্বকাপ জয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিশেষ সেগমেন্ট। জনগণের জ্ঞানের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে বিবিএমসি কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. অরিজিৎ দাস রাশিয়ায় ক্যান্সার প্রতিরোধে উদ্ভাবিত প্রতিষেধক সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানের সামগ্রিক সঞ্চালনায় ছিলেন প্রকৌশলী শুভাশিস কর ও উপস্থাপিকা শ্বাশতী ভট্টাচার্য।

পুরো অনুষ্ঠানটি ছিল উৎসবময়—হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি, প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের কর্মকতা, সৃজনশীল ও সাংবাদিক মহল— সব মিলে তৈরি করেছিল এক অনন্য চিত্র।

সন্ধ্যায় চূড়ান্ত পর্ব শেষে বিভিন্ন বিভাগে বিজয়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় পুরস্কার ও সম্মাননা-স্মারক। বিদ্যালয় বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ের অঙ্গদ সেন ও শায়ন সাহা; দ্বিতীয় উমাকান্ত একাডেমির কৃষ্ণাশীষ পাল ও পরাগ দত্ত; তৃতীয় প্রণবানন্দ বিদ্যামন্দিরের তানিশা পাল ও সমর্পিতা রায়। এই বিভাগে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিজয়ীদের অর্জিত অর্থ পুরস্কার যথাক্রমে ২০,০০০, ১০,০০০ ও ৫,০০০ টাকা।

উন্মুক্ত বিভাগে শীর্ষে ছিলেন অম্লান গুপ্ত ও সৌপ্তিক চক্রবর্তী; দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন অরুণেশ চক্রবর্তী ও ত্রিপন পাল; তৃতীয় স্থান পেয়েছেন ইমন পোদ্দার ও দেবাশীষ চক্রবর্তী। উন্মুক্ত বিভাগের মূল পুরস্কার ছিল ৩০,০০০ টাকা (প্রথম), ২০,০০০ টাকা (দ্বিতীয়) ও ১০,০০০ টাকা (তৃতীয়) সঙ্গে শুভেচ্ছা-স্মারক।

দর্শক আসনের মধ্যে থেকে সবচেয়ে বেশি সঠিক প্রশ্নোত্তরকারী হিসেবে সেরা পুরস্কার জিতে নেন সৌভিক মজুমদার। সেরা স্কুল হিসেবে সম্মান অর্জন করে ভারতীয় বিদ্যাভবন, আর কলেজ স্তরে শীর্ষে উঠে আসে মহিলা মহাবিদ্যালয়।

২০০৬ সালে সূচনা হওয়া এই মেগা কুইজ আজ কুড়ি বছরে পা রেখে প্রমাণ করল, কুইজ কেবল প্রতিযোগিতা নয়, বরং জ্ঞানের ধারাবাহিক অনুশীলন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও জিজ্ঞাসাকে উজ্জীবিত রাখার এক শক্তিশালী মাধ্যম। খুদে প্রতিযোগীর নিঃসঙ্কোচ আত্মবিশ্বাস থেকে শুরু করে প্রবীণ অতিথিদের অভিজ্ঞ ধ্যান-ধারণা, সবকিছু মিলে তৈরি করল এক সার্থক দিনব্যাপী জ্ঞান-উৎসব, যেখানে প্রতিটি প্রশ্ন ছিল নতুন চিন্তার স্পন্দন।

ত্রিপুরা ইনফোর এই ধারাবাহিক প্রয়াস রাজ্যের বুকে জ্ঞানচর্চার ও বুদ্ধিবৃত্তির এক অনবদ্য ঠিকানা হয়ে রয়েছে এবং ঠিকানাটি আজও আগের মতোই উজ্জ্বল।

আরও পড়ুন...


Post Your Comments Below

নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।

বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।

Free Download Avro Keyboard

Fields with * are mandatory





Posted comments

Till now no approved comments is available.