উনিশের ভাষা আন্দোলন ও নকল আদালত
পান্নালাল রায়
May 17, 2025
ওপারের একুশে ফেব্রুয়ারির মতো মাতৃভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এপারেও অমর হয়ে আছে উনিশে মে।১৯৬১ সালের এই দিনটিতেই মাতৃভাষার জন্য শিলচরে শহিদ হয়েছিল এগারো জন।কি ভাবে সৃষ্টি হয়েছিল উনিশে তা নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে।আগামী দিনেও নিশ্চিত এই চর্চা অব্যাহত থাকবে।এই ভাষা আন্দোলনকে কেউ কেউ গণ অভ্যুত্থান হিসেবে অভিহিত করেছেন। দীর্ঘ মেয়াদি এই আন্দোলনে দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে অনেক কিছু।প্রত্যক্ষ করেছে মাতৃভাষার সুরক্ষার জন্য সকলের ঐক্যবদ্ধ হবার চিত্রটি।এই ভাষা আন্দোলনে সেদিন শিলচরের মানুষ সাক্ষী হয়েছিলেন নকল আদালতের মাধ্যমে এক অভিনব পিকেটিং'রও।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী তখন বিমলা প্রসাদ চালিহা।১৯৬০ সালের অক্টোবরে আসাম বিধানসভায় পাস হয়ে গেল রাজ্যভাষা বিল।এই বিলে সারা আসামের একমাত্র সরকারি ভাষা হলো অসমীয়া।স্বাভাবিক ভাবেই এই ভাষা বিলের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলো বঙ্গভাষাভাষি সেদিনের অবিভক্ত কাছাড়।প্রতিবাদ মুখর হলো আসামের অন্যান্য সংখ্যালঘু ভাষাগোষ্ঠীর মানুষও। অবশ্য সলতে পাকাবার কাজটি শুরু হয়েছিল আরও আগেই।আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি সে বছরের ২২শে এপ্রিল অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একক সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব নিয়েছিল। যদিও কাছাড়ের বাংলা ভাষাভাষি সদস্যরা এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু ৫০-১০ ভোটে তা অগ্রাহ্য হয়ে যায়।তারপর কাছাড়ের মানুষ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শুরু হয় সভা-সমিতি-সম্মেলন।ব্রক্ষ্মপুত্র উপত্যকার বাংলা ভাষাভাষিরাও এই আন্দোলনে সামিল হতে শিলচর আসেন।শিলচরে অনুষ্ঠিত নিখিল আসাম বাঙ্গালা ভাষা সম্মেলন এবং অনসমীয়া ভাষা সম্মেলনে ভাষা ইস্যুতে স্হিতাবস্হা বজায় রাখার প্রস্তাব গৃহীত হয়।কিন্তু এতসবে কিছুই হলোনা। ২৪ অক্টোবর কাছাড়ের সদস্যদের অনুপস্থিতি এবং গারো ও খাসি জয়ন্তিয়া পাহাড়ের সদস্যদের বিরোধিতার মধ্যে আসাম বিধানসভায় পাস হয়ে গেল ভাষা বিল।তারপর সমগ্র কাছাড় তথা আজকের বরাক উপত্যকা জুড়ে শুরু হয়ে যায় তীব্র আন্দোলন।অসমীয়া ভাষার সমান মর্যাদা দাবি করা হয় বাংলা ভাষার।কিন্তু বরাক উপত্যকার তীব্র বিরোধিতা ও আন্দোলন সত্ত্বেও ডিসেম্বর মাসে ভাষা বিল আসামের রাজ্যপালের অনুমোদন লাভ করে।স্বাভাবিকভাবেই বরাকের ভাষা আন্দোলন এরপর আরও তীব্রতা পায়।
১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারিতে করিমগঞ্জ শহরে অনুষ্ঠিত হয় কাছাড় জেলা জন-সম্মেলন।আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে কাছাড়ের সর্বত্র। মার্চ মাসে মুখ্যমন্ত্রী চালিহার করিমগঞ্জ ও শিলচর সফরের দিনে পালিত হয় সর্বাত্মক হরতাল।এপ্রিল মাসে সঙ্কল্প দিবস উদযাপন সহ শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। গ্রাম বরাকে চলতে থাকে পদযাত্রা। চারদিকে শঙ্খধ্বনি,উলুধ্বনি,মাতৃভাষা জিন্দাবাদ শ্লোগান।চারদিকে এক রব-জান দেব,জবান দেবনা।১৯ মে থেকে বরাক জুড়ে ব্যাপক ভাবে সত্যাগ্রহ তথা আইন আমান্য আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়।মে মাসে সভা সমাবেশে উত্তাল হয়ে উঠে বরাক।১৯ মে ডাক দেয়া হয় সর্বাত্মক হরতালের। সেদিন শিলচর শহরের পথে পথে জনস্রোত।মা বোনেরাও বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে।রেল স্টেশনেও ছিল সত্যাগ্রহীদের ভিড়।এক সময় শুরু হলো লাঠিচার্জ,তারপর কাঁদানে গ্যাস।কিন্তু রেল লাইন থেকে সরানো গেলনা সত্যাগ্রহীদের।শহরের সব সরকারি অফিস এদিন বন্ধ হয়ে পড়েছিল সত্যাগ্রহের জন্য।অচল হয়ে পড়েছিল জেলা প্রশাসন।বেলা ১১টার মধ্যে শিলচরে দুই হাজার সত্যাগ্রহীকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু সেদিন আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল শিলচর রেল স্টেশন। বেলা আড়াইটা নাগাদ হঠাৎই পিকেটারদের উপর শুরু হয় গুলিবর্ষণ।একে একে রক্তাপ্লুত দেহগুলো লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।কিন্তু তারপরও সত্যাগ্রহ চলতে থাকে।শিলচর সংগ্রাম পরিষদের মাইকে ঘোষিত হতে থাকে বিকেল চারটার আগে কেউ যেন রেলস্টেশনে নিজেদের জায়গা না ছাড়েন।এ যেন এক অভূতপূর্ব আন্দোলন।নির্বিচারে গুলি বর্ষণের মুখেও অবিচল।এদিকে আহত ও নিহতদের নিয়ে হাজার হাজার মানুষ ছুটলেন হাসপাতাল।বিকেলে প্রায় বিশ হাজার মানুষের সমাবেশ ঘটে গেল হাসপাতাল চত্ত্বরে।উত্তেজনায় কাঁপছে শিলচর। দাবানলের মতো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে গুলির খবর।বিকেল পাঁচটা থেকে শহরে জারি হয় কার্ফু।পরদিন কার্ফু অগ্রাহ্য করে শবদেহ গুলো নিয়ে প্রায় অর্দ্ধ লক্ষ মানুষের মিছিল বের হয়।
এদিকে সেদিন গৌহাটিতে অবস্হানরত প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত নেহরুর সঙ্গে কাছাড়ের কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ দেখা করে শিলচরে গুলিবর্ষণের কথা জানান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কাছে সরকারি স্তরে এমন খবর ছিল যে,আন্দোলনকারীরা স্টেশনে অগ্নিসংযোগ সহ সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করছিল।তাই গুলি চালানো হয়েছিল। কিন্তু প্রতিনিধিদল এর প্রতিবাদ করে বলেন, এই খবর মোটেই ঠিক নয়। সেখানে অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলন চলছিল। যাইহোক, বিনা প্ররোচনায় এই গুলিবর্ষণের ঘটনা নিয়ে বিস্তর আলোচনা পর্যালোচনা হয়েছে।বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছে।তদানীন্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী শিলচর সফর করেছেন। তার আগেই ভাষা সমস্যা সমাধানে এক সূত্র তিনি শিলং থেকে ঘোষণা করেন।
ঊনিশে মে গুলিবর্ষণে শহিদ হলেন-সত্যেন্দ্র দেব,চন্ডীচরণ সূত্রধর,বীরেন্দ্র সূত্রধর,সুনীল সরকার,হীতেশ বিশ্বাস, সুকোমল পুরকায়স্হ,কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্র পাল,তরণী দেবনাথ, কানাইলাল নিয়োগী,কুমুদ দাস। অবশ্য এগারো জন শহিদ হবার পরও আন্দোলন থামেনি।আর নানা ঘটনা ঘিরে বাড়তে থাকে অশান্তিও। ভাষা আন্দোলন বানচালের উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি সহ নানা উশৃঙ্খল আচরণও চলতে থাকে কাছাড়ের নানা অংশে।হাইলাকান্দিতে গোলাগুলি হয়।মৃত্যু ঘটে দশ জনের।
যাইহোক, মাতৃভাষা সুরক্ষার লক্ষ্যে একটি আন্দোলন ঘিরে এগারোজন শহিদ হবার পরেও কি ভাবে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলে সত্যাগ্রহ তা ভাবলে আজ বিস্মিত হতে হয়।আর আন্দোলনের মাধ্যমও ছিল অভিনব।শোকসভা,ঘরে ঘরে অরন্ধন,ঘরে ঘরে কালো পতাকা,শহিদদের চিতাভষ্ম নিয়ে শোক মিছিল, ঘরে ঘরে শহিদদের উদ্দেশ্যে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন- সব মিলিয়ে সর্বস্তরের মানুষকে যুক্ত করা হয়েছিল এই আন্দোলনের সঙ্গে।তবে সম্ভবত সবচেয়ে অভিনব পিকেটিং ছিল নকল আদালত।পিকেটাররা আদালতের দখল নিয়ে কেউ হয়েছিলেন জজ,কেউ উকিল, কেউবা পেশকার।বিচার হয়েছিল 'অভিযুক্ত' মুখ্যমন্ত্রী চালিহার। 'অপরাধী'দের 'দন্ডদান' সহ বাংলাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণার 'রায়'ও দেয়া হয়েছিল।সেদিন এই ঘটনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্ব পেয়েছিল। কলকাতার কাগজ গুলোতে বেরিয়েছিল জজ কোর্ট দখলের সচিত্র সংবাদ।
সেদিনটা ছিল ৭ জুন।জজ সেজেছিলেন তরুণী গোপা দত্ত।পরবর্তী সময়ে তিনি তাঁর সেদিনের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন এই ভাবে-"...আমরা বন্দেমাতরম বলে কোর্টের দিকে রওয়ানা দিলাম।...আমিও সটান গিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমার আসনের কাছে।...মনে মনে বন্দেমাতরম স্মরণ করে আসন গ্রহণ করলাম। অন্য সবাই স্ব স্ব আসনে বসলো।শুরু হলো আমাদের কৃত্রিম আদালত কার্য।...আমার পেশকারের কাজ করছিলেন মনীন্দ্র রায়।উকিলের দলে ছিলেন নিয়তি চক্রবর্তী,বাসন্তী চক্রবর্তী,সমর দেব,শরদিন্দু,রঞ্জিত ভট্টাচার্য, মিহির কান্তি চৌধুরী।জুরির ভূমিকায় ছিলেন হীরেন দেব,পরেশ পাল,নির্ম্মল চক্রবর্তী।আসামীর কাঠগড়ায় শ্রী চালিয়া সেজে হাত জোড় করে দাঁড়ালেন আমাদের সত্যাগ্রহী ভাই সত্য ঘোষ।..." সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে জানা যায় নির্দিষ্ট নিয়মেই চলছিল নকল আদালতের বিচার পর্ব।খবর ছড়িয়ে পড়তেই আদালত চত্ত্বর লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে।ছুটে যান সাংবাদিকরাও।জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সহ পুলিশ কর্তারাও ছুটে আসেন।সশস্ত্র পুলিশ ঘিরে ফেলে আদালত ভবন।আদালতের এজলাস ছেড়ে চলে যাবার জন্য বারংবার সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুরোধ প্রত্যাহৃত হয়।এদিকে বিচারের রায়ও ঘোষিত হয়ে যায়। মুখ্যমন্ত্রী-মন্ত্রীদের কাউকে 'মৃত্যুদন্ড',কাউকে 'কারাবাস'।বিচারের রায় ঘোষণার পর পিকেটারদের সবাইকে গ্রেপ্তার করে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়।বিচারে সংশ্লিষ্ট সবার সাতদিনের কারাবাস ও আর্থিক জরিমানা হয়। শিলচরে ভাষা আন্দোলনের শীর্ষ নেতা পরিতোষ পাল চৌধুরী তাঁর 'রক্তাঞ্জলি-বাংলা ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস' গ্রন্হে বলেছেন,' ...শেষপর্যন্ত গৌহাটি হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির অনুমতি নিয়ে গোপা দত্তকে শিলচর পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পেরেছিল।'
মাতৃভাষা সুরক্ষার আন্দোলনের ক্ষেত্রে যেমন উজ্জ্বল হয়ে আছে উনিশে মে,তেমনই ইতিহাস হয়ে আছে কাছাড়ের ভাষা সংগ্রামে এক অভিনব পিকেটিং নকল আদালতের কথাও!শুধু বাংলা কেন,পৃথিবীর যে কোনও অঞ্চলে মাতৃভাষা সুরক্ষার আন্দোলনের ক্ষেত্রে উনিশে মে যেন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।নির্বিচার গুলির মুখেও সত্যাগ্রহীদের দৃঢ়তা,সভা-সমাবেশ, ঘরে ঘরে অরন্ধন,প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ইত্যাদির মাধ্যমে এক গণজাগরণ সৃষ্টি-সব মিলিয়ে উনিশে মে আরও অনেক অনেক কাল জাগরূক থাকবে সব দেশের সব ভাষা প্রেমিকদের হৃদয়ে হৃদয়ে।
আরও পড়ুন...