পূর্বোত্তরে ড্রাগ-এইডস, বাড়ছে উদ্বেগ
পান্নালাল রায়
July 7, 2025
উত্তর পূর্বাঞ্চলের যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ড্রাগ আসক্তি আজ রীতিমত উদ্বেগের সঞ্চার করেছে।শিরাপথে ড্রাগ ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এইডস সংক্রমণের হারও বেড়ে চলেছে।ড্রাগ পাচার ও তার ব্যবহার প্রতিরোধের পাশাপাশি এই অঞ্চলে এইচআইভি সংক্রমণ প্রতিরোধেও সাম্প্রতিককালে সরকারি স্তরে ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে।
ত্রিপুরা সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন পত্র পত্রিকা তথা মিডিয়ায় প্রায় প্রতিদিনই ড্রাগ উদ্ধারের নানা খবরাখবর প্রকাশিত হয়।আর তাজ্জব ব্যাপার হচ্ছে উদ্ধারকৃত এই ড্রাগের পরিমাণ টাকার অঙ্কে আজ শত শত কোটি ছাড়িয়ে যাচ্ছে! এটাও ঘটনা যে,বেআইনি পাচারকৃত ড্রাগের সামান্য একটি অংশই হয়তো ধরা পড়ছে।বেশিরভাগই হয়তো পাচার হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে এই অঞ্চলের যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে।কোটি কোটি টাকার ড্রাগ উদ্ধারের ঘটনায় এটাও ধারণা হয় যে,এই অঞ্চলে ড্রাগকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি টাকার এক বিপুল বাণিজ্য চক্র গড়ে উঠেছে।শুধু তাই নয়,মাদকাসক্তি ঘিরে ঘরে ঘরে অশান্তির ঘটনাও নিত্য ঘটছে।ড্রাগের অর্থের যোগান না দিলে প্রবল ড্রাগ আসক্ত পুত্রের হাতে মা বাবা আক্রান্ত হচ্ছেন।ইচ্ছায় হোক,অনিচ্ছায় হোক,ড্রাগ আসক্ত কিশোর-যুবকদের মধ্যে আজ অপরাধ প্রবণতাও বাড়ছে।চুরি ছিনতাই থেকে খুন-জখমের ঘটনাও ঘটছে।আসক্তরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে।ড্রাগের কবলে এমন অশান্তির ঘটনার পাশাপাশি আবার মাত্রাতিরিক্ত ড্রাগ ব্যবহারের ফলে আসক্তের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে চলেছে।পূর্বোত্তরের মণিপুর, মিজোরামে এ ধরণের মৃত্যুর ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে।অপরিমিত ড্রাগ সেবনের ফলে ২০২৪-২৫ সালে মিজোরামে ৪৬ জনের মৃত্যু ঘটেছে।এর মধ্যে ৩ জন মহিলাও রয়েছেন। সব মিলিয়ে আমাদের সমাজ জীবনে যেন এক অন্ধকার নেমে আসার সংকেত পাওয়া যাচ্ছে।আমরা যেন এক জালে জড়িয়ে পড়ছি।এই জাল থেকে কি ভাবে বেরিয়ে আসা যায় তাই আজ সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।ড্রাগ আসক্তির ফলে ছড়িয়ে পড়ছে মারণ রোগ এইডসও। এমনকি কিশোর বয়স্ক ছাত্রদের মধ্যেও আজ ড্রাগ আসক্তি বাড়ছে,ছড়াচ্ছে এইচআইভি সংক্রমণ।
উত্তর পূর্বাঞ্চলের যুব সম্প্রদায়ের একাংশের মধ্যে ড্রাগ আসক্তি বৃদ্ধি কিন্তু রাতারাতি সৃষ্টি হয়নি।দীর্ঘদিনেই এই ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে আজ।আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজর এড়িয়ে কি ভাবে শহর থেকে গঞ্জের হাট পর্যন্ত ড্রাগ পাচারের চক্র গড়ে উঠল,পাড়ায় পাড়ায় তার বিপনন হল তা নিঃসন্দেহে এক বড় প্রশ্ন। ড্রাগ প্রতিরোধে সভা-সমিতি,ভাষণ বক্তৃতা হচ্ছে বিস্তর,কোটি কোটি টাকার ড্রাগ ধরাও পড়ছে।কিন্তু শেষপর্যন্ত কাজের কাজ কতটা হচ্ছে?ত্রিপুরায় লক্ষ লক্ষ গাঁজার গাছ ধ্বংস করার পরও ধরা পড়ছে কোটি কোটি টাকার গাঁজা।এমনটা কেন ঘটছে? এটা ঘটনা যে,ধীরে ধীরে আজকের এই ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও তার তৃণমূল স্তরের কর্মীদের দুর্বলতা বা সচেতন অবহেলার সুযোগে আজ এমন অবস্থা হয়েছে।ড্রাগ পাচারের বিরাট চক্রের তৎপরতা রয়েছে দেশ-বিদেশে।মায়ানমার থেকে মণিপুর,মিজোরাম হয়ে ড্রাগ পাচার হচ্ছে।এই ড্রাগ পাচার ও গাঁজার চাষ কার্যত উত্তর পূর্বাঞ্চলে যেন এক সমান্তরাল অর্থনীতি কায়েম করেছে।কাজেই এটা ধরে নেয়া যায় যে,আগে যত সহজে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা সম্ভব ছিল এখন আর তা ততটা সহজে সম্ভব নয়।সরকারও অবশ্য বর্তমানে যুদ্ধকালীন তৎপরতার সঙ্গে ড্রাগ প্রতিরোধে এগিয়ে এসেছে।ব্যাপক হারে ধরপাকড় চলছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ড্রাগ বিরোধী দিবসের অনুষ্ঠানে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডাঃমানিক সাহা বলেছেন, রাজ্য সরকার রাজ্যে ড্রাগ আসক্তদের পুনর্বাসনে উদ্যোগ নিয়েছে।রাজ্যের আটটি জেলাতে এ জন্য কেন্দ্র স্থাপন হবে।এই সব কেন্দ্রে আসক্তদের ড্রাগ আসক্তি থেকে মুক্ত তথা সুস্হ করা হবে।প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য ব্যয় হবে ২০ কোটি টাকা।মুখ্যমন্ত্রী আরও জানান,সিপাহিজলা জেলার বিশ্রামগঞ্জে একটি বিশেষ ড্রাগ ডি-এডিকশন সেন্টারের জন্য ডোনার মন্ত্রণালয় থেকে ১৯৮ কোটি টাকা ইতিমধ্যেই মঞ্জুর করা হয়েছে।পাশাপাশি বেসরকারি ড্রাগ ডি-এডিকশন সেন্টার গুলো পর্যবেক্ষণে সংশ্লিষ্ট নিয়ম নীতি প্রণয়নেও সরকার উদ্যোগী হয়েছে।মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ভৌগলিক অবস্থানের জন্য ড্রাগ পাচার চক্র ত্রিপুরাকে করিডর হিসেবে ব্যবহার করছে।তবে ড্রাগ আসক্তি ও তার বেআইনি পাচারের বিরুদ্ধে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছে।সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নিরলস ভাবে কাজ করছে এ জন্য। গত বছরে ড্রাগ ও বেআইনি পাচারকৃত সামগ্রী ১০৩ গুণ বেশি উদ্ধার হয়েছে এর আগের বছরের তুলনায়।
এবার আসা যাক,এইডস রোগাক্রমণের কথায়।শিরাপথে ড্রাগ ব্যবহারের জন্য এইডস রোগের বিস্তার ঘটছে।সম্প্রতি এমন একটি তথ্য সামনে এসেছে যা রীতিমত উদ্বেগের। ত্রিপুরাতে প্রতিমাসে ১২০ জন এইডস রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।সম্প্রতি বিধানসভার লবিতে ত্রিপুরা এইডস কন্ট্রোল সোসাইটি ও রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর আয়োজিত এক জনসচেনতা মূলক আলোচনা সভায় এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে।চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত তথ্যানুযায়ী ত্রিপুরায় পাঁচ হাজারেরও বেশি এইডস রোগী রয়েছেন। তার মধ্যে আবার মহিলার সংখ্যা সহস্রাধিক। আরও জানা যায় যে,২০২৩-২৪ সালে রক্ত পরীক্ষায় ১৪০০ জনের শরীরে এই রোগের ভাইরাস পাওয়া গেছে।প্রসঙ্গত এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে,সব আক্রান্ত কিম্বা সম্ভাব্য আক্রান্তদের রক্ত পরীক্ষার আওতায় আনা যেমন সম্ভব হয় না,সংশ্লিষ্ট তথ্য সংগ্রহ তথা সমীক্ষাতেও তেমনই ঘাটতি থেকে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়।কিন্তু এর মধ্যেও যে সব তথ্য বেরিয়ে আসছে তা আমাদের উদ্বেগ বাড়িয়ে চলেছে।ত্রিপুরাতে এইডস রোগে আক্রান্তের হার জাতীয় গড়ের প্রায় দ্বিগুণ।আর শুধু ত্রিপুরা কেন, এইডস রোগাক্রমণে আজ গোটা উত্তর পূর্বাঞ্চলই যেন এক বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে গেছে।ত্রিপুরার তুলনায় মিজোরাম, নাগাল্যান্ডে এইডস সংক্রমণের হার অনেক বেশি।অসমে অবশ্য তা জাতীয় হারের তুলনায় কম হলেও স্বস্তির অবকাশ নেই। রাজ্যে শিরাপথে যারা ড্রাগ নিচ্ছে তাদের মধ্যে এইডস সংক্রমণের হার দ্রুত বাড়ছে।এখানে উল্লেখ করা যায় যে,অসুরক্ষিত যৌনাচার ছাড়াও উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে শিরাপথে ড্রাগ ব্যবহারকারীদের মধ্যেও সাম্প্রতিককালে এইচআইভি সংক্রমণ ভয়াবহ ভাবে বাড়ছে।উত্তর পূর্বাঞ্চলের যুব সম্প্রদায়ের একাংশের মধ্যে ড্রাগ আসক্তি বৃদ্ধি যেমন উদ্বেগের সঞ্চার করছে,তেমনই এইডস সংক্রমণ বৃদ্ধিও আজ এই উদ্বেগ আরও অনেক গুণ বাড়িয়ে তুলছে।ত্রিপুরা সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলে এইডস ছড়ানোর মূলে আজ ক্রম বর্ধমান মাদকাসক্তির প্রাবল্যকে অনেকাংশে দায়ী করা হচ্ছে।
ত্রিপুরা বিধানসভার লবিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এইডস প্রতিরোধে জনসচেনতা মূলক আলোচনায় মুখ্যমন্ত্রী,মন্ত্রী ও বিধায়কগণ অংশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন।স্কুল স্তরে অষ্টম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাক্রমে সেক্স ও ড্রাগ এডুকেশন অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব এসেছে।এইডস প্রতিরোধে গুরুত্ব আরোপ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, সকলকে এজন্য ঐক্যবদ্ধ ভাবে এগিয়ে আসতে হবে।সচেতনতার অভাবেই এইডস রোগাক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।তাই সচেতনতা মূলক অভিযান জোরদার করতে হবে।রাজ্যে এইডস আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন,শিক্ষা দপ্তরের আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যবস্থায় সেক্স এডুকেশন ও ড্রাগ এডুকেশন যুক্ত করা যেতে পারে।মন্ত্রী রতনলাল নাথ মন্ত্রী-বিধায়কদের উদ্দেশ্যে অনুরোধে জানিয়ে বলেন, তারা যেন সরকারি বেসরকারি নানা অনুষ্ঠানে অন্তত পাঁচ মিনিট এইডস নিয়ে আলোচনা করেন।
যাইহোক, ড্রাগ আসক্তি,বেআইনি বাণিজ্য চক্র এবং এইডস সংক্রমণের বিস্তার যে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না।মুখ্যমন্ত্রী,মন্ত্রী সহ শীর্ষ সরকারি কর্তৃপক্ষ আজ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন। ড্রাগের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা ঘোষিত হচ্ছে।স্বাভাবিকভাবেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তৎপরতা এতে বাড়বে।কিন্তু তারপরও বলতে হয় শুধুমাত্র সরকারি উদ্যোগই এ ক্ষেত্রে মোটেই যথেষ্ট নয়।এনজিও সহ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। শুধুমাত্র সভা-সম্মেলনের মাধ্যমে পোশাকী কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ না থেকে শহর-গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় তাদের ড্রাগ বিরোধী তৎপরতা চালাতে হবে।সর্বস্তরের জনণকেও এ জন্য এগিয়ে আসতে হবে।ড্রাগের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ। একমাত্র সকলের সম্মিলিত উদ্যোগই পর্যুদস্ত করতে পারবে ড্রাগ নামের দৈত্যকে!
আরও পড়ুন...