মার্কিন শুল্ক হামলায় ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ শ্রম-নিবিড় শিল্প অস্তিত্ব সংকটের মুখে : একটি পর্যালোচনা।
ড: সঞ্জয় রায়।
August 21, 2025
গত ১ আগস্ট ২০২৫ তারিখে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় রপ্তানির উপর ২৫% শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞা না মেনে ভারত রাশিয়ান তেল ক্রয় অব্যাহত রাখার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প ৬/৮/২০২৫ তারিখে জরিমানা সূচক আরও অতিরিক্ত ২৫% শুল্ক ঘোষণা করেন। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় পন্য রপ্তানির উপর এখন অন্তত ৫০% শুল্ক আগামি ২৭/৮/২০২৫ থেকে বলবৎ হচ্ছে। আর এই শুল্কের প্রভাব বিভিন্ন শিল্পে বিভিন্ন রকম এবং এ নিয়ে বিভিন্ন মতামত উঠে আসছে। উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি ছিল প্রায় ৮৬.৫ বিলিয়ন ডলার যা ২০২৩-২৪ বছরে ৭৭.৫২ বিলিয়ন ডলার থেকে ১১.৬% বেশি। ২০২৪-২৫ সালে আমদানি ৭.৪৪% বেড়ে ৪৫.৩৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা ২০২৩-২৪ সালে ৪২.২ বিলিয়ন ডলার ছিল। গত অর্থ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ৪১.১৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা ২০২৩-২৪ সালে ৩৫.৩২ বিলিয়ন ডলার ছিল।
২০২৪ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের প্রধান রপ্তানির মধ্যে ছিল ফার্মাসিটিক্যালস ($৮.১ বিলিয়ন), টেলিকম যন্ত্রপাতি ($৬.৫ বিলিয়ন), মূল্যবান এবং আধা-মূল্যবান পাথর ($৫.৩ বিলিয়ন), পেট্রোলিয়াম পণ্য ($৪.১ বিলিয়ন), সোনা এবং অন্যান্য মূল্যবান ধাতুর গহনা ($৩.২ বিলিয়ন), তুলার তৈরি পোশাক, আনুষাঙ্গিক ($২.৮ বিলিয়ন) এবং লোহা ও ইস্পাতের পণ্য ($২.৭ বিলিয়ন)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে ভারতের বৃহত্তম রপ্তানি বাজার, যা ভারতের মোট পণ্য রপ্তানির প্রায় ১৮%। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুল্ক বৃদ্ধির ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় পণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে, ফলে ভারতীয় পণ্যের চাহিদা হ্রাস পাবে। মার্কিন বাজারের উপর নির্ভরশীল শিল্পগুলিতে কর্মসংস্থানের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলস্বরূপ, ভারতীয় রপ্তানির মোট পরিমাণ হ্রাস পেতে পারে এবং বৈদেশিক মুদ্রার মন্দার ফলে দেশের জিডিপিতে প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে ভারতীয় রপ্তানির উপর বর্ধিত মার্কিন শুল্ক ভারতের চাকরির বাজারে, বিশেষ করে টেক্সটাইল, অটো যন্ত্রাংশ এবং রত্ন ও অলঙ্কারে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব ফেলবে। এক অনুমান অনুসারে ২,০০,০০০ থেকে ৩,০০,০০০ চাকরি তাৎক্ষণিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, শুল্ক ব্যবস্থা আগামী ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকলে শ্রম-নিবিড় টেক্সটাইল শিল্পে সম্ভবত ১,০০,০০০ চাকরি হারাতে পারে।
তারা আরও বলেন যে, তাৎক্ষণিক চাপ অস্থায়ী এবং চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের উপর পড়বে, বিশেষ করে শপ-ফ্লোর কর্মী, কারিগর, বিক্রয় ও সরবরাহ কর্মী এবং রপ্তানি-নেতৃত্বাধীন ইউনিটগুলিতে কিছু মধ্য-স্তরের ব্যবস্থাপকদের উপর। এর ফলে হাজার হাজার ক্ষুদ্র খাত এবং মাঝারি উদ্যোগের সরবরাহ শৃঙ্খলে (MSME)-এর উপর প্রভাব পড়বে, যেখানে সম্মিলিতভাবে কর্মসংস্থানের একটি বড় অংশের লোক কর্মে নিয়োজিত। উচ্চ আমদানি খরচের জন্য ক্রেতারা সিদ্ধান্ত পুনর্মূল্যায়ন করায় অনেক রপ্তানি আদেশ ইতিমধ্যেই স্থগিত রাখা হয়েছে। বিপুল সংখ্যক এমএসএমই অন্তর্গত উদ্যোগের পক্ষে, এই আকস্মিক ব্যয় বৃদ্ধি শোষণ করা সম্ভব নয়। "মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এর ভারতীয় পন্যের লাভের পরিমাণ ইতিমধ্যেই কম, আর এই অতিরিক্ত ধাক্কা রপ্তানিকারকদের দীর্ঘস্থায়ী ক্লায়েন্ট হারাতে বাধ্য করতে পারে," বলে অনেক রপ্তানীকারক বলছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রভাব সম্পর্কে পার্লামেন্টে এক প্রশ্নের জবাবে, কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্প প্রতিমন্ত্রী জানান যে অনুমান করা হচ্ছে যে ভারতের পণ্য রপ্তানির (২০২৪ সালের বাণিজ্য মূল্যের উপর ভিত্তি করে) প্রায় ৪৮.২ বিলিয়ন ডলারের শুল্ক আরোপ করা হবে। ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশনস (FIEO) এটিকে "একটি গুরুতর ধাক্কা" হিসাবে বর্ণনা করেছে যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় পণ্যের ৫৫ শতাংশেরও বেশি রপ্তানির উপর প্রভাব ফেলবে। এই শুল্ক ভারতের ৪৩৪ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি ইঞ্জিনকে হুমকির মুখে ফেলেছে, যার মধ্যে ৮৭ বিলিয়ন ডলার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হবে, যা ভারতের জিডিপির ২.৫% এর সমান। শিল্প অনুমান অনুসারে, কেবলমাত্র ইঞ্জিনিয়ারিং রপ্তানিতে ৪-৫ বিলিয়ন ডলারের হ্রাস ঘটবে, যেখানে সামগ্রিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ০.২-০.৫% হ্রাস পেতে পারে, পূর্বাভাস ৬.৫% থেকে সংশোধিত হয়ে ৬% হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের (MSMEs) অন্তর্গত বস্ত্র এবং চামড়ার শিল্প ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়েছে কারন তাদের শুল্ক কম। অফশোর বাজারে ভারতীয় রুপির মান দুর্বল হয়ে পড়েছে, যার ফলে আমদানিকৃত মুদ্রাস্ফীতি এবং বিদেশী ঋণে জর্জরিত কোম্পানিগুলির ঋণ গ্রহণের খরচ বৃদ্ধির উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। উপলব্ধ তথ্য ইতিমধ্যেই দেখায় যে ভারতে শীতবস্ত্র এবং টেক্সটাইল খাত, সামুদ্রিক খাবার, রত্ন ও অলংকার, চামড়াজাত পণ্য, ইস্পাত এবং অ্যালুমিনিয়াম খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে এই নিবন্ধে উপরে উল্লিখিত কয়েকটি খাত এবং অংশীদারদের উপর কী পরিমাণ প্রভাব পড়বে তার এক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
Knitwear and Textiles sector ( শীতবস্ত্র এবং টেক্সটাইল খাত)
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণা করা ৫০ শতাংশ শুল্ক হামলায় নিটওয়্যার এবং টেক্সটাইল খাত এক বিশাল চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ইতিমধ্যেই ভারতের তামিলনাডুর তিরুপুরের নিটওয়্যার রপ্তানিকারকরা তার তীব্রতা অনুভব করছেন। তারা বলছেন যে প্রাপ্ত সব অর্ডার অর্ডার স্থগিত বা সেগুলি বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ার মতো প্রতিযোগীদের কাছে, পুনঃনির্দেশিত বা সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যাচ্ছে, কারন সেই সমস্ত দেশ সমুহের জন্য মার্কিন শুল্ক হার ১৯% থেকে ৩৬% এর মধ্যে রয়েছে। তামিলনাডুর তিরুপুরের একজন রপ্তানিকারক গণমাধ্যমকে ব্রিফ করেছেন যে তার নিয়মিত মার্কিন চালান ইতিমধ্যেই পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে। অন্য একজন বলেছেন যে তার আমেরিকান ক্রেতা তাকে গ্রীষ্মকালীন অর্ডার নিশ্চিত করার আগে "অপেক্ষা" করতে বলেছেন। বেসলাইন এবং প্রতিকার-সংযুক্ত শুল্ক সহ সংশোধিত শুল্ক সব একসাথে যোগ করলে এখন কিছু নিটওয়্যারের জন্য কার্যকর হার ৬৪% দাঁড়িয়েছে, যার ফলে আঞ্চলিক প্রতিযোগীদের তুলনায় পণ্য ৩৫% পর্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। প্রাথমিকভাবে যাকে একটি বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হয়েছিল তা এখন রপ্তানিকারকরা "একটি কার্যত বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা" হিসাবে দেখেন। নিটওয়্যার রপ্তানিকারকদের সংগঠন উল্লেখ করেছে যে, "স্বতন্ত্র রপ্তানিকারক কোম্পানিগুলি প্রথমে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্রেতারা ইতিমধ্যেই রপ্তানিকারকদের শুল্কের কিছু অংশ বহন করতে বলছে। কিন্তু তারা অসহায় অবস্থায় রয়েছে কারণ তাদের ‘মার্জিন’ হার মাত্র ৫% থেকে ৭%। বস্ত্র একটি শ্রম-নিবিড় খাত, এবং বাজার সংকুচিত হলে চাকরি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। অর্ডার হ্রাসের কারণে যদি রপ্তানি ১০-২০% কমে যায়, তাহলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তিনটি কেন্দ্র - তিরুপুর, করুর এবং কোয়েম্বাটুরে - সম্মিলিতভাবে ১০০,০০০-২০০,০০০ টেক্সটাইল এবং পোশাকের চাকরি হুমকির মুখে পড়তে পারে। তিরুপুর একাই নিটওয়্যার রপ্তানিতে ৪০,০০০ কোটি টাকা অবদান রাখে, যা ওয়ালমার্ট, জিএপি এবং কস্টকোর মতো বিশ্বব্যাপী জায়ান্টদের সরবরাহ করে এবং দেশের নিটওয়্যার রপ্তানির ৫৫%। এই অঞ্চলটি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এটি ১০-১৫% সম্প্রসারিত করার আশা করেছিল। এখন পরিস্থিতি ভয়াবহ, তাই বিশ্লেষকরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রগামী অর্ডার, বিশেষ করে তুলা এবং বোনা পোশাকের ক্ষেত্রে ৪০-৫০% হ্রাসের পূর্বাভাস দিয়েছেন। । বিশ্বব্যাপী টেক্সটাইল বাজার অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক; ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের এই ধরণের শাস্তিমূলক বৃদ্ধির মুখোমুখি হতে হয় নি। বাংলাদেশ ৩৫-৩৬% কার্যকর হারে পণ্য রপ্তানি অব্যাহত রেখেছে, পাকিস্তান সফলভাবে ১৯% শুল্ক নিয়ে আলোচনা করেছে, ভিয়েতনাম ২০-২১% এবং কম্বোডিয়া, যদিও আগে ৪৯% ছিল, ১ আগস্ট সংশোধনের পর এখন ১৯% হারে রপ্তানি করছে। তুলনামূলকভাবে, ভারতের হার ৫০%, তা কেবল বিচ্ছিন্ন নয় বরং অভূতপূর্ব।
Shrimp cultivators (চিংড়ি চাষীগন)
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের চিংড়ি চাষীরা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত শুল্কের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই খাতে মোট শুল্ক হবে ৫৯,৭২% ( ঘোষিত শুল্ক ২৫% + পেনাল্টি ২৫%+ ৫.৭৬% কাউন্টারভেলিং শুল্ক এবং ৩.৯৬% অ্যান্টি-ডাম্পিং)। উল্লেখ্য, এপ্রিলের আগে চিংড়ির উপর শুল্ক ছিল ১৬.৫২% যা এখন বেড়ে ৫৯.৭২% হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী অন্ধ্রপ্রদেশে প্রায় ৬.৫ লক্ষ জলজ চাষী রয়েছেন, প্রায় ৩০-৪০ লক্ষ অন্যান্য যারা শিল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত, তাদের জীবিকাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। পূর্ববর্তী অবিভক্ত জেলা কৃষ্ণা, পূর্ব গোদাবরী এবং পশ্চিম গোদাবরী থেকে উৎপাদিত চিংড়ির ৬০% আসে। অন্যদিকে ওড়িশা বার্ষিক ২০০০ কোটি টাকার সামুদ্রিক খাবার, বিশেষ করে চিংড়ি রপ্তানি করে, ৩০% এরও বেশি চালান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যায়, শিল্প সূত্র জানিয়েছে। এই খাতটি ওড়িশার প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি করে। উচ্চতর আমদানি খরচের আলোকে ক্রেতারা সোর্সিং সিদ্ধান্ত পুনর্মূল্যায়ন করায় অনেক রপ্তানি আদেশ ইতিমধ্যেই স্থগিত রাখা হয়েছে। "যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০% শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তে অটল থাকে, তাহলে অনেক চিংড়ি চাষি তাদের ব্যবসা বন্ধ করতে বা অন্যান্য প্রজাতির চাষ করতে বাধ্য হবে কারন লাভের পরিমান খুব কম।" অন্ধ্রপ্রদেশ মৎস্য বিভাগের যুগ্ম পরিচালক (জলজ পালন) এস লাল মোহাম্মদ বলেন। পশ্চিমবঙ্গে চিংড়ি চাষীদের সঠিক সংখ্যা স্পষ্টভাবে বলা না হলেও, পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় প্রচুর পরিমাণে চিংড়ি চাষ করা হয়। যেহেতু এটি একটি অর্থকরী ফসল, তাই জেলায় চিংড়ি চাষের পরিধি বাড়ছে। জেলার উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ত জল চিংড়ি চাষের জন্য উপযুক্ত। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নদী তীরবর্তী এলাকায় নন্দকুমার, নন্দীগ্রাম, কাঁথি, চন্ডিপুর, রামনগর এবং খেজুরি সহ বিস্তৃত অঞ্চলে ‘সাদা সোনা’ নামে পরিচিত বিভিন্ন ধরণের চিংড়ি চাষ করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে চিংড়ি চাষের জন্য উপযুক্ত একটি বিশাল লবণাক্ত জলরাশি রয়েছে এবং এটি ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম চিংড়ি উৎপাদনকারী। পশ্চিমবঙ্গের ১,০০,০০০-এরও বেশি কৃষক, বিশেষ করে পূর্ব মেদিনীপুরের মতো জেলাগুলিতে, চিংড়ি চাষ করছেন। এই শিল্প প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিপুল সংখ্যক লোককে নিয়োগ করে। প্রতি বছর, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন রপ্তানিকারকরা চার থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার চিংড়ি বিদেশে রপ্তানি করেন। কিন্তু বর্তমানে ৫০% শুল্ক আরোপের ফলে উৎপাদন ও রপ্তানিতে এক অনিশ্চয়তার মেঘ দেখা যাচ্ছে। শুল্ক ছাড়াও, এই শিল্প ইকুয়েডরের কাছ থেকে বিশেষভাবে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হচ্ছে, যা মার্কিন বাজারে ভারতের অংশ গ্রাস করছে । "ইকুয়েডর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি, এবং শুল্ক মাত্র ১৫%। মূল্যের দিক থেকে ইকুয়েডর এক বিশাল সুবিধা ভোগ করছে, এবং ভারত যদি এখনই মার্কিন বাজার হারিয়ে ফেলে তবে বাজার পুনরুদ্ধার করা পক্ষে কঠিন হতে পারে।
রত্ন ও অলংকার
ভারতের রত্ন ও অলংকার রপ্তানিকারকরা মার্কিন বাজারের উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। তাই ৫০ শতাংশ উচ্চ শুল্ক ভারতীয় রপ্তানিকে অপ্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে বলে কর্মসংস্থান হ্রাসের আশঙ্কা রয়েছে, রত্ন ও অলংকার রপ্তানি উন্নয়ন কাউন্সিল (জিজেইপিসি) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে। পঞ্চাশ শতাংশ শুল্ক রত্ন ও অলংকার খাতের জন্য মারাত্মকভাবে ধ্বংসাত্মক । গত পাঁচ বছরে রত্ন ও অলংকার এর রপ্তানি ৩৫ বিলিয়ন থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ছিল, ২০২০-২০২১ অর্থবছর ছাড়া ( COVID-19 মহামারীর কারণে) যখন ২৬ রপ্তানি বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ অ্যাপ্লাইড ইকোনমিক রিসার্চ (NCAER) এর জরিপ অনুসারে, ২০১৯ সালে ভারতে রত্ন ও অলংকরণ খাতে মোট ৯.৮৯ লক্ষ ইউনিট এবং ৪২.৮৯ লক্ষ কর্মী ছিল। প্রায় ৩৮.১১ বিলিয়ন ডলারের মোট রপ্তানি সহ এই খাতটি ২০২২-২৩ সালে ভারতের পণ্য রপ্তানির ৮.৪৫ শতাংশ ছিল এবং দেশের জন্য শীর্ষ পাঁচটি শীর্ষস্থানীয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাতের মধ্যে রয়েছে, জিজেইপিসি জানিয়েছে। রপ্তানিকারকরা বলেছেন যে মার্কিন শুল্কের ফলে অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে - "গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত হবে, রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে এবং হাজার হাজার কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়বে" - কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই খাতের একক বৃহত্তম বাজার, যা ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি রপ্তানি করে, এবং শিল্পের মোট বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রায় ৩০ শতাংশ।
চামড়া শিল্প
ভারতের চামড়া শিল্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত শুল্কের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উল্লেখ্য, বিশ্বজুড়ে ভারতের চামড়া রপ্তানি ২০২০-২১ সালে ৩,৬৮১ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২৪-২৫ সালে ৪,৮২৮ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে - যা ৩১% বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ৬৪৫ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ১,০৪৫ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে - যা ৬২% বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারতীয় পণ্যের উপর শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত - চামড়ার জুতার উপর শুল্ক ৫-৮% থেকে বাড়িয়ে ৫০% হচ্ছে, আর এই সিদ্ধান্ত চামড়া শিল্পের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। চামড়া শিল্প তার ব্যবসার ৮০ শতাংশ রপ্তানির উপর নির্ভরশীল। রপ্তানিকারকরা অর্ডার বাতিল এবং বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম এবং পাকিস্তানের মতো প্রতিযোগী দেশগুলিতে ব্যবসা স্থানান্তরের ফলে ভারী আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন। যেসব নির্মাতারা সম্প্রতি মার্কিন বাজারে পা রাখতে শুরু করেছেন, তাদের জন্য এই পদক্ষেপ একটি উল্লেখযোগ্য ধাক্কা হিসেবে দেখা দিয়েছে। কলকাতা, কানপুর এবং চেন্নাইয়ের পাশাপাশি আগ্রা ভারতের অন্যতম বৃহত্তম পাদুকা উৎপাদন কেন্দ্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় চামড়াজাত পণ্যের উপর আমদানি শুল্ক ৬০% আরোপ করছে যা চীনের উপর আরোপিত হারের দ্বিগুণ এবং পাকিস্তান (১৯%) এবং বাংলাদেশের (২০%) চেয়ে অনেক বেশি। ফলে এই শিল্প অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি। রপ্তানিকারকরা আশঙ্কা করছেন যে এই পদক্ষেপের ফলে কানপুর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিকৃত বার্ষিক ২০০০ কোটি টাকার বাণিজ্য প্রায় সবই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। কানপুরের এক বিখ্যাত চামড়া ব্যবসায়ী সতর্ক করে বলেছেন যে শুল্ক বৃদ্ধি কানপুর এবং পার্শ্ববর্তী উন্নাওকে ধ্বংস করতে পারে, যেখানে এই শিল্পে প্রায় ১০ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে। চামড়ার আনুষাঙ্গিক এক রপ্তানিকারক বলেন, নতুন নীতি নিয়ে বিভ্রান্তির কারণে উৎপাদন প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে চাহিদা ইতিমধ্যেই পূর্ববর্তী স্তরের ৬০%-এ নেমে এসেছে, যার ফলে কিছু ইউনিট কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে। চামড়া রপ্তানি কাউন্সিলের (মধ্য অঞ্চল) চেয়ারম্যান বলেছেন যে বড়দিনের অর্ডার এসে গেলেও মার্কিন বাজারের জন্য উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
বিপরীত মতামত
তবে, সকলেই অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে এক মত নন। ভারতের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ভি অনন্ত নাগেশ্বরণের মতে, মার্কিন শুল্কের প্রভাব আগামী এক বা দুই কোয়ার্টারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাবে এবং দেশটি যখন এগিয়ে চলেছে তখন বেসরকারি খাতকে আরও কিছু করার আহ্বান জানিয়েছেন। সরকার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত এবং প্রভাবিত খাতগুলির সাথে ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু হয়ে গেছে, নাগেশ্বরণ বলেন। আগামী দিন এবং সপ্তাহগুলিতে নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে বিস্তৃত জানা যাবে । তবে মানুষকে ধৈর্য ধরতে হবে, তিনি আরও যোগ করেন যে আগামী বছরগুলিতে আমরা যে বিশাল কৌশলগত চ্যালেঞ্জগুলির মুখোমুখি হচ্ছি তার পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি খাতকেও অনেক চিন্তাভাবনা করতে হবে। বেসরকারি খাতকেও পরবর্তী ত্রৈমাসিকের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্কে ভাবতে হবে।
টিমলিজ সার্ভিসেসের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বালাসুব্রহ্মণ্যম অনন্ত নারায়ণন মনে করেন যে, ভারত মূলত একটি অভ্যন্তরীণ ভোগ-চালিত অর্থনীতি, চীনের মতো নয় । তাই, মার্কিন শুল্কের কোনও প্রভাব চাকরির উপর প্রভাব ফেলবে না। “এই সময়ে, আমরা মন্দা বা চাকরি হ্রাসের কোনও লক্ষণ দেখছি না। এর অর্থ হল আইটিইএসের মতো কিছু ক্ষেত্র বাদে আমাদের চাকরিগুলি মূলত অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের জন্যও কাজ করছে ,” নারায়ণন বলেন। তিনি আরও বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রপ্তানি ৮৭ বিলিয়ন ডলার, যা আমাদের সামগ্রিক জিডিপির প্রায় ২.২ শতাংশ। মূলত ফার্মা, ইলেকট্রনিক্স ইত্যাদি আপাতত প্রভাবিত হবে না, যা টেক্সটাইল, রত্ন এবং গহনার মতো শিল্পগুলিতে রপ্তানি এক্সপোজারকে আরও সীমিত করবে।” তিনি আরও যোগ করেছেন যে যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য দেশের সাথে সম্প্রতি ঘোষিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) থেকে প্রাপ্ত ইতিবাচক দিকগুলি সম্ভবত ভারতীয় পণ্যের রপ্তানি সম্পূর্ণ বন্ধ করার পরিবর্তে পুনঃনির্দেশনার পথ তৈরি করতে পারে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির এই মন্দা মূলত বিশ্বব্যাপী চাহিদা এবং ভোগের সামগ্রিক মন্দা, শুল্ক সম্পর্কিত অনিশ্চয়তা এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে। তারমতে “যদিও এই মার্কিন শুল্ক আরোপ করা হয়, আমরা অবশ্যই অন্যান্য বাজারে আমাদের বাণিজ্য পুনর্নির্দেশনা বা বৈচিত্র্যকরণের একটি উপায় খুঁজে বের করব”।
মার্কিন শুল্ক ভারতে বিনিয়োগ প্রবাহকে প্রভাবিত করবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, 'চীন প্লাস ওয়ান' কৌশল গত কয়েক বছর ধরে ব্যবসার জন্য কার্যকর হয়েছে এবং কোম্পানিগুলি মূলত অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর জন্য ভারতে ব্যবসা স্থাপন করছে। "অনেকে (ব্যবসা) কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করার জন্য নয় বরং তাদের অনেকেই বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজারের কারণেও সেখানে যাচ্ছে। একটি উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্রমশ বড় হচ্ছে। তাই, যারা ভারতে আরও বিনিয়োগ করতে এবং রপ্তানি করতে চাইছেন তাদের জন্যও এটি মার্কিন বাজার নাও হতে পারে," তিনি বলেন।
ভারতীয় অর্থনীতির উপর মার্কিন শুল্কের প্রভাব নিয়ন্ত্রণযোগ্য হবে এবং ভারতের দীর্ঘমেয়াদী প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার উপর কোনও প্রভাব না পড়লে সামগ্রিক প্রভাব সামান্য হতে পারে, রেটিং এজেন্সি এসএন্ডপি গ্লোবাল জানিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন, ভারতের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে এবং নয়াদিল্লি যদি রাশিয়ান তেল কেনা বন্ধ না করে তবে উচ্চতর, দ্বিতীয় শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছে। “আমরা বিশ্বাস করি ভারতীয় অর্থনীতির উপর মার্কিন শুল্কের প্রভাব নিয়ন্ত্রণযোগ্য হবে। ভারত বাণিজ্যের উপর তুলনামূলকভাবে কম নির্ভরশীল এবং এর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রায় ৬০ শতাংশ আসে অভ্যন্তরীণ ব্যবহার থেকে”। সংস্থাটি জানিয়েছে যে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারতীয় অর্থনীতির পারফরম্যান্স তার ঐতিহাসিক স্থিতিস্থাপকতা তুলে ধরে। এটি দৃঢ় প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে। সংস্থাটি আরও বলেছে যে মহামারীর আগের তুলনায় ভারতের কর্পোরেট এবং আর্থিক খাতের ব্যালেন্স শিট শক্তিশালী। "তবে তারা স্বীকার করছে যে অর্থনীতির পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি করতে, বৈষম্য কমাতে এবং তার অনুকূল জনসংখ্যার পূর্ণ সুবিধা পেতে ভারতের উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার দীর্ঘ সময় ধরে টিকিয়ে রাখতে হবে”। গত ১৮ আগস্ট, ২০২৫ লোকসভায় এক লিখিত জবাবে বাণিজ্য ও শিল্প প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকার দেশের জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত ও এগিয়ে নিতে এবং কৃষক, শ্রমিক, উদ্যোক্তা, রপ্তানিকারক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং শিল্পের সকল বিভাগের কল্যাণ রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি আরও বলেন, যথাযথ রপ্তানি প্রচার এবং বাণিজ্য বৈচিত্র্যকরণ ব্যবস্থা সহ বাণিজ্যের উপর প্রভাব কমাতে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ফলে সক্লকেই এখন নীতিনির্ধারকদের নির্দেশ অনুযায়ী পরিস্থিতি গভীরভাবে লক্ষ্য এবং পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
আরও পড়ুন...