ভিবি-জি রামজি (VB-G RAM G) বনাম এমজিএন রেগা (MGNREGA): গ্রামীণ কর্মসংস্থানে নতুন নিয়ম

জয়ন্ত দেবনাথ

December 21, 2025   

ভিবি-জি রামজি (VB-G RAM G) বনাম এমজিএন রেগা (MGNREGA): গ্রামীণ কর্মসংস্থানে নতুন নিয়ম

বিকশিত ভারত গ্যারান্টি ফর রোজগার অ্যান্ড আজীবিকা মিশন গ্রামীণ (VB-G RAM G),  ২০২৫ সালের ১৮ ডিসেম্বরে ভারতের লোকসভায় পাস হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিল, যা ২০০৫ সালের মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন (MGNREGA) বা ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। এই বিলটির মূল বৈশিষ্ট্য হল এই নতুন আইনের অধীনে গ্রামীণ পরিবার গুলোর জন্য বার্ষিক কর্মসংস্থানের গ্যারান্টি ১০০ দিন থেকে বাড়িয়ে ১২৫ দিন করা হয়েছে। ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫-এ বিলটি লোকসভায় পাস হয় এবং ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫-এ রাজ্যসভাতে পাস হয়। বর্তমানে এটি অনুমোদনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়েছে। 
প্রকল্পের নাম থেকে 'মহাত্মা গান্ধী'-র নাম বাদ দিয়ে 'রাম' (রোজগার অ্যান্ড আজীবিকা মিশন) যুক্ত করায় এবং কাজের অধিকারের কাঠামো পরিবর্তনের আশঙ্কায় বামফ্রন্ট, তৃণমূল কংগ্রেস ও কংগ্রেস সহ অধিকাংশ বিরোধী দল গুলো সংসদে নতুন আইনের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।  এই বিলে বায়োমেট্রিক অথেন্টিকেশন এবং মোবাইল-ভিত্তিক নজরদারির মতো প্রযুক্তিনির্ভর সংস্কারের কথা বলা হয়েছে।  এছাড়া কৃষি কাজের মরসুমে কাজের ক্ষেত্রে ষাট দিনের 'সিজনাল পজ' বা সাময়িক  বিরতির বিধান রাখা হয়েছে। 
বিলের পক্ষের শাসক দলের সাংসদদের মতে, গ্রামীণ ভারতের কর্মসংস্থান ব্যবস্থায় নতুন আইনটির মাধ্যমে একাধিক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা হবে। কিন্ত বিরোধীদের মতে, নতুন আইনের কারণে গ্রামীণ ভারতে গরীব মানুষের কর্মদিবস কমবে। কেননা,  এই পরিবর্তন শুধুমাত্র কর্মদিবসের সংখ্যাতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সরকারের ভূমিকা, অর্থায়নের কাঠামো, পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রযুক্তি ব্যবহারের ধরন এবং গ্রামীণ উন্নয়নের দর্শন সব কিছুতেই মৌলিক রদবদল ঘটতে চলেছে।
২০০৫ সালে জাতীয় নিশ্চিত কর্মসংস্থান আইন নামে যে আইন চালু হয়, ২০০৯ সালে তার নামকরণ হয় মহাত্মা গান্ধীর নামে। এই আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ পরিবারের জীবিকা সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং প্রতি অর্থবছরে স্বেচ্ছায় অদক্ষ শ্রমে আগ্রহী প্রত্যেক পরিবারকে অন্তত ১০০ দিনের মজুরি ভিত্তিক কাজের নিশ্চয়তা দেওয়া। প্রায় দুই দশক ধরে এই প্রকল্প গ্রামীণ ভারতের সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করেছে।
অন্যদিকে, ভিবি-জি রামজি বিল (VB-G RAM G Bill, 2025) নিজেকে বিকশিত ভারত ২০৪৭ (Viksit Bharat 2047)-এর জাতীয় লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি নতুন গ্রামীণ উন্নয়ন কাঠামো হিসেবে উপস্থাপন করেছে। এই বিলের মাধ্যমে সরকার গ্রামীণ কর্মসংস্থানকে কেবল কাজের নিশ্চয়তা নয়, বরং উৎপাদনশীল সম্পদ সৃষ্টি, অবকাঠামো উন্নয়ন ও জলবায়ু-ঝুঁকি মোকাবিলার সঙ্গে যুক্ত করতে চাইছে।
কর্মদিবসের নিশ্চয়তা এম জি এন রেগা যেখানে বছরে ১০০ দিনের কাজের নিশ্চয়তা দিত, সেখানে ভিবি-জি রামজি বিল (VB-G RAM G Bill, 2025)-এ সেই সংখ্যা বাড়িয়ে ১২৫ দিন করা হয়েছে। সংখ্যাগত ভাবে এটি ইতিবাচক হলেও, এর বাস্তব প্রয়োগ সম্পূর্ণ ভাবে রাজ্য ভিত্তিক বরাদ্দ ও পরিকল্পনার উপর নির্ভরশীল হবে।
এমজিএন রেগা (MGNREGA) একটি সম্পূর্ণ চাহিদা ভিত্তিক প্রকল্প ছিল। অর্থাৎ গ্রামে কাজের চাহিদা বাড়লে কেন্দ্র সরকারকে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করতেই হত। ভিবি-জি রামজি বিল (VB-G RAM G Bill)-এ সেই দর্শন বদলেছে। এখানে রাজ্য গুলিকে একটি নির্দিষ্ট ‘নরমেটিভ অ্যালোকেশন’ দেওয়া হবে এবং তার বেশি ব্যয় হলে সেই অতিরিক্ত অর্থের দায়ভার রাজ্য সরকারকেই বহন করতে হবে। এতে কেন্দ্রের আর্থিক দায় কিছুটা কমলেও রাজ্য গুলির উপর চাপ উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়বে।
অর্থায়নের কাঠামো এমজিএন রেগাতে শ্রমিকদের মজুরি সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্র সরকার বহন করত এবং উপকরণ খরচ কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ৭৫:২৫ অনুপাতে ভাগ হত। নতুন ভিবি-জি রামজি বিল (VB-G RAM G Bill, 2025)-এ রাজ্য গুলির আর্থিক অংশগ্রহণ আরও বাড়ানো হয়েছে। উত্তর-পূর্ব ও হিমালয়ান রাজ্য গুলির ক্ষেত্রে কেন্দ্র-রাজ্য অনুপাত হবে ৯০:১০, অন্য রাজ্য ও বিধানসভা যুক্ত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্য ৬০:৪০। বিধানসভাহীন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সম্পূর্ণ খরচ বহন করবে কেন্দ্র সরকার।
কাজের সময়সীমা ও কৃষি মৌসুম এমজিএন রেগাতে সারা বছরই কাজ চাওয়া যেতো। কিন্তু ভিবি-জি রামজি বিল (VB-G RAM G Bill, 2025)-এ রাজ্য সরকার কৃষির বপন ও ফসল কাটার ষাট দিনের মৌসুমকে ‘নিষিদ্ধ সময়’ হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে, যে সময়ে এই প্রকল্পে কাজ চাওয়া যাবে না। এর ফলে কৃষি শ্রমের সঙ্গে প্রকল্পের সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা থাকলেও, কর্মসংস্থানের ধারাবাহিকতা প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে।
এমজিএন রেগাতে জল সংরক্ষণ, খরা প্রতিরোধ, সেচ, ঐতিহ্যবাহী জলাধার সংস্কার, ভূমি উন্নয়ন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের মতো বিস্তৃত ক্ষেত্রেই কাজ করানোর সুযোগ ছিল। ভিবি-জি রামজি বিল (VB-G RAM G Bill, 2025) - এ এই কাজ গুলিকে চারটি নির্দিষ্ট থিমে সাজানোর  চেষ্টা হয়েছে।  যেমন, জল নিরাপত্তা, মূল গ্রামীণ অবকাঠামো, জীবিকা ভিত্তিক অবকাঠামো এবং চরম দুর্যোগ বা আবহাওয়া মোকাবিলা সংক্রান্ত বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রেই এখন ভিবি-জি রামজি আইনে  কাজ করানোর সুযোগ  রাখা হয়েছে।
আগে কাজ প্রদানের ক্ষেত্রে এমজিএন রেগাতে গ্রাম পঞ্চায়েত ও গ্রামসভার প্রধান ভূমিকা ছিল । প্রকল্প নির্বাচন, কাজের অগ্রাধিকার ও বাস্তবায়নের বড় অংশ গ্রামস্তরেই নির্ধারিত হতো এবং কমপক্ষে ৫০ শতাংশ কাজ পঞ্চায়েতের মাধ্যমে বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা ছিল। ভিবি-জি রামজি আইনে কাজের উৎস হবে বিকশিত গ্রাম পঞ্চায়েত প্ল্যান (Viksit Gram Panchayat Plan), যা পি এম গতিশক্তী (PM Gati Shakti) ন্যাশনাল মাস্টার প্ল্যান (National Master Plan)-এর সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। পাশাপাশি, প্রতিটি পঞ্চায়েতকে উন্নয়ন সূচকের ভিত্তিতে এ বি সি  (A, B, C) শ্রেণিতে ভাগ করে ‘স্যাচুরেশন মোড’ পরিকল্পনা তৈরির কথা বলা হয়েছে, যা এমজিএন রেগাতে ছিল না।
ভিবি-জি রামজি আইনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এর ব্যাপক ডিজিটাল কাঠামো। বায়োমেট্রিক অথেন্টিকেশন, জিপিএস বা মোবাইলভিত্তিক কাজের স্থান পর্যবেক্ষণ, স্বয়ংক্রিয় জনসমক্ষে তথ্য প্রকাশ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে পরিকল্পনা, অডিট ও জালিয়াতি ঝুঁকি নিরসনের কথা বলা হয়েছে।এমজিএন রেগাতে-তে এধরনের সমন্বিত প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবস্থার উল্লেখ ছিল না।
ভিবি-জি রামজি আইনে গ্রামীণ কর্মসংস্থানে একটি নতুন দর্শন,  উন্নয়ন, প্রযুক্তি ও দক্ষতা-ভিত্তিক পরিকল্পনার দিকে এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিলেও, চাহিদা ভিত্তিক অধিকারমূলক চরিত্র থেকে সরে আসায় সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্ন উঠছে। আগামী দিনে এই নতুন ব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করবে রাজ্য গুলির আর্থিক সক্ষমতা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং বাস্তবে গ্রামীণ মানুষের জীবনে এর প্রভাবের উপর।
(লেখক জয়ন্ত দেবনাথ একজন সিনিয়র সাংবাদিক ও ত্রিপুরাইনফো-র সম্পাদক)
   (Tripurainfo)

more articles...